ঢাকা ১২:২১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মার্কিন নির্বাচন যেভাবে বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে

নিজস্ব সংবাদ :

ছবি সংগৃহীত

মার্কিন নির্বাচন যেভাবে বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে গত বছরের (২০২৩) ফেব্রুয়ারিতে কিয়েভ সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার আকস্মিক ওই সফর ছিল ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে সংহতি প্রদর্শনের লক্ষ্যে। বাইডেনকে পেয়ে জেলেনস্কি বলেন, ‘আপনাকে পেয়ে আমার নিজেকে আগের চেয়ে আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী লাগছে।’ কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের জন্য একটা আশার বাতিঘর।’

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প।

জেলেনস্কির চোখে সেই ‘আশার বাতিঘর’ যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে মার্কিনিরা আগামী চার বছরের জন্য তাদের নেতা হিসেবে কাকে বেছে নেন, সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বিশ্ববাসী। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে বাইডেনের পদাঙ্ক অনুসরণ অব্যাহত রাখবেন? নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে তার ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি এগিয়ে নেবেন?

 

বর্তমানে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভাব তা নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের নিজস্ব পথে হাঁটছে। স্বৈরাচারী সরকারগুলো তাদের নিজস্ব জোট তৈরি করছে। গাজা, ইউক্রেন ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিধ্বংসী যেসব যুদ্ধ চলছে তাতে ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করছে।
 
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এবং অনেক জোটে তার প্রধান ভূমিকার কারণে এখনও গুরুত্বপূর্ণ। এমন অবস্থায় দেশটির আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এবং এর ফলাফল বিশ্বে কি প্রভাব ফেলবে বা ফেলতে পারে তা বিশ্লেষকরা নানাভাবে বিচার, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করছেন।
  

ন্যাটোর ওপর যে প্রভাব ফেলতে পারে

 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ন্যাটোর সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন ন্যাটোর সাবেক উপমহাসচিব রোজ গোটেমোয়েলার বলছেন, ‘(ট্রাম্পের) হুঁশিয়ারিগুলোকে সুগারকোট করা সম্ভব নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের দুঃস্বপ্ন। কেননা তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে প্রত্যাহারের যে হুমকি দিয়ে রেখেছেন তা সবার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।’
 
ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা ব্যয় ন্যাটোর ৩১ সদস্যের মোট সামরিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ। ন্যাটোর বাইরে চীন ও রাশিয়াসহ তালিকার পরবর্তী ১০টি দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক খাতে বেশি ব্যয় করে। ট্রাম্প বলে আসছেন, তিনি অন্যান্য ন্যাটো দেশগুলোকে জোটে তাদের সামরিক ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণ করতে বাধ্য করবেন তিনি।
 
সদস্য দেশগুলোর তাদের জিডিপির ২ শতাংশ জোটের সামরিক তহবিলে দেয়ার কথা। কিন্তু চলতি বছর (২০২৪) পর্যন্ত মাত্র ২৩টি সদস্য দেশ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। ট্রাম্প এটা মানবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। তার জয় পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
 
 
বিপরীতে হ্যারিস জিতলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। গোটেমোয়েলার মতে, ‘হ্যারিসের জয়ে ন্যাটো নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের হাতে ভালো থাকবে। কিন্তু সেখানেও তার একটা সতর্কতা আছে। তিনি ইউক্রেনে বিজয় অর্জনের জন্য ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে তিনি ইউরোপের ওপর ব্যয় বিষয়ে চাপ থেকে পিছপা হবেন না।’
 
তবে হোয়াইট হাউসে হ্যারিসের দলকে সিনেট বা হাউস তথা কংগ্রেসের উভয় কক্ষকে মানিয়ে চলতে হবে। যেখানে কংগ্রেসের উভয় কক্ষই শিগগিরই রিপাবলিকানদের হাতে চলে যেতে পারে এবং তারা ডেমোক্রেটিকদের তুলনায় বিদেশি যুদ্ধের প্রতি কম আগ্রহী হবে।
 
ক্রমবর্ধমান একটি ধারণা রয়েছে যে, যিনিই প্রেসিডেন্ট হন না কেন, এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করার জন্য কিয়েভের ওপর চাপ বাড়বে। কারণ মার্কিন আইনপ্রণেতারা বিশাল সহায়তা প্যাকেজ পাস করতে ক্রমশ অনিচ্ছুক হয়ে উঠছে।
  

মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত ইস্যুতে

 

মার্কিন নির্বাচনে অন্যতম প্রধান আলোচিত ইস্যু মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় দলই এ নিয়ে কথা বলেছেন এবং এখনও বলে যাচ্ছেন। গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে সংঘটিত গণহত্যার ক্ষেত্রে উভয় দলের নেতারা একই অবস্থান নিয়েছেন এবং এ ঘটনার পক্ষে উভয় শিবিরই সমর্থন দিয়ে আসছে।
 
অর্থাৎ গাজায় ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসন ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। উভয়ে একই অবস্থান নিয়েছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সমর্থিত নেতা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য তারা সমানভাবে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
 
দুজন প্রার্থীই বোমাবর্ষণ, ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা, চিকিৎসার সুযোগ না দেয়া, রোগের বিস্তার ঘটানো, জোরপূর্বক স্থানান্তর ইত্যাদিসহ সেই সব ভয়ংকর নীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ফলে গাজায় ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এসব নিহত মানুষের একটা বড় অংশই নারী ও শিশু।
 
শুধু কৌশলগতভাবে নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় গাজা ও পশ্চিম তীরে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র দ্বারা সংঘটিত এসব অপরাধ বর্ণনা করতে ট্রাম্প ও হ্যারিস উভয়েই ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। 
 
 
উভয় রাজনৈতিক দল ইসরাইলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দিচ্ছে এবং যারা এ অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাদের সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, অর্থাৎ যে-ই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না কেন, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের তেমন কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
 
যদিও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা বলছেন, ‘নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধ করতে হবে’। তবে তিনি বারবার এ কথাও বলছেন যে, ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ রয়েছে। যা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেই শুরু থেকেই বলে আসছেন। 
 
অন্যদিকে ট্রাম্প একদিকে বলছেন যে, ‘শান্তি ফেরানোর এবং মানুষ হত্যা বন্ধ করার সময় এসেছে’। তবে তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এ কথাও বলে দিয়েছেন যে, ‘তোমার যা করা তা করো’। যার মানে, তিনি নেতানিয়াহুকে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন।
  

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ওপর প্রভাব

 

ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে আপাতদৃষ্টিতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক নেতাদের অবস্থান একে অপরের বিরোধী বলেই প্রতীয়মান হয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই কিয়েভের জেলেনস্কি সরকারকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক- সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে জো বাইডেন প্রশাসন। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার কোটি ডলার সরবরাহ করেছে তারা।
 
ডেমোক্রেটিক মনোনীত প্রার্থী হ্যারিস স্পষ্টভাবেই বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে পারলে নিজেকে গর্বিত মনে করবেন। তার কথায়, ‘আমি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াবো। এবং এই যুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয় নিশ্চিত করতে আমি কাজ করব।’ ফলে এটা ধরেই নেয়া যায়, কমলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, ইউক্রেন ইস্যুতে তার সরকারের বর্তমান অবস্থানই অব্যাহত থাকবে।
 
 
বিপরীতে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের বিষয়ে বলতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করতে কখনও পিছপা হননি ট্রাম্প। সেই সঙ্গে তিনি বারবার স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তিনি এই যুদ্ধের অবসান চান। তবে সামরিক ও আর্থিক সমর্থনের আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি এক নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, ‘আমি (ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে) বের হব। আমাদেরকে বের হতে হবে।
 
অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কঠোর সমালোচনা করেছেন রিপাবলিকান এ নেতা। গত অক্টোবরের মাঝামাঝি পিবিডি পডকাস্টে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘জেলেনস্কি হলেন আমার দেখা সবচেয়ে সেরা বিক্রয়কর্মী। যতবার তিনি আসেন, আমরা তাকে ১০ হাজার কোটি ডলার করে দিয়ে দিই। ইতিহাসে আর কে এভাবে অর্থ পেয়েছেন? কখনোই কেউ নন। আর এর মানে এই নয় যে আমি তাকে সহযোগিতা করতে চাই না। কারণ মানুষগুলোর জন্য আমার খারাপ লাগে। তাঁর কখনোই এ যুদ্ধ শুরু হতে দেয়া উচিত হয়নি।’
 
সূত্র: বিবিসি, আলজাজিরা 
  

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০৬:২০:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪
১৬ বার পড়া হয়েছে

মার্কিন নির্বাচন যেভাবে বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে

আপডেট সময় ০৬:২০:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪

মার্কিন নির্বাচন যেভাবে বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে গত বছরের (২০২৩) ফেব্রুয়ারিতে কিয়েভ সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার আকস্মিক ওই সফর ছিল ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে সংহতি প্রদর্শনের লক্ষ্যে। বাইডেনকে পেয়ে জেলেনস্কি বলেন, ‘আপনাকে পেয়ে আমার নিজেকে আগের চেয়ে আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী লাগছে।’ কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের জন্য একটা আশার বাতিঘর।’

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প।

জেলেনস্কির চোখে সেই ‘আশার বাতিঘর’ যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে মার্কিনিরা আগামী চার বছরের জন্য তাদের নেতা হিসেবে কাকে বেছে নেন, সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বিশ্ববাসী। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে বাইডেনের পদাঙ্ক অনুসরণ অব্যাহত রাখবেন? নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে তার ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি এগিয়ে নেবেন?

 

বর্তমানে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভাব তা নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের নিজস্ব পথে হাঁটছে। স্বৈরাচারী সরকারগুলো তাদের নিজস্ব জোট তৈরি করছে। গাজা, ইউক্রেন ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিধ্বংসী যেসব যুদ্ধ চলছে তাতে ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করছে।
 
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এবং অনেক জোটে তার প্রধান ভূমিকার কারণে এখনও গুরুত্বপূর্ণ। এমন অবস্থায় দেশটির আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এবং এর ফলাফল বিশ্বে কি প্রভাব ফেলবে বা ফেলতে পারে তা বিশ্লেষকরা নানাভাবে বিচার, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করছেন।
  

ন্যাটোর ওপর যে প্রভাব ফেলতে পারে

 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ন্যাটোর সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন ন্যাটোর সাবেক উপমহাসচিব রোজ গোটেমোয়েলার বলছেন, ‘(ট্রাম্পের) হুঁশিয়ারিগুলোকে সুগারকোট করা সম্ভব নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের দুঃস্বপ্ন। কেননা তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে প্রত্যাহারের যে হুমকি দিয়ে রেখেছেন তা সবার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।’
 
ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা ব্যয় ন্যাটোর ৩১ সদস্যের মোট সামরিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ। ন্যাটোর বাইরে চীন ও রাশিয়াসহ তালিকার পরবর্তী ১০টি দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক খাতে বেশি ব্যয় করে। ট্রাম্প বলে আসছেন, তিনি অন্যান্য ন্যাটো দেশগুলোকে জোটে তাদের সামরিক ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণ করতে বাধ্য করবেন তিনি।
 
সদস্য দেশগুলোর তাদের জিডিপির ২ শতাংশ জোটের সামরিক তহবিলে দেয়ার কথা। কিন্তু চলতি বছর (২০২৪) পর্যন্ত মাত্র ২৩টি সদস্য দেশ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। ট্রাম্প এটা মানবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। তার জয় পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
 
 
বিপরীতে হ্যারিস জিতলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। গোটেমোয়েলার মতে, ‘হ্যারিসের জয়ে ন্যাটো নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের হাতে ভালো থাকবে। কিন্তু সেখানেও তার একটা সতর্কতা আছে। তিনি ইউক্রেনে বিজয় অর্জনের জন্য ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে তিনি ইউরোপের ওপর ব্যয় বিষয়ে চাপ থেকে পিছপা হবেন না।’
 
তবে হোয়াইট হাউসে হ্যারিসের দলকে সিনেট বা হাউস তথা কংগ্রেসের উভয় কক্ষকে মানিয়ে চলতে হবে। যেখানে কংগ্রেসের উভয় কক্ষই শিগগিরই রিপাবলিকানদের হাতে চলে যেতে পারে এবং তারা ডেমোক্রেটিকদের তুলনায় বিদেশি যুদ্ধের প্রতি কম আগ্রহী হবে।
 
ক্রমবর্ধমান একটি ধারণা রয়েছে যে, যিনিই প্রেসিডেন্ট হন না কেন, এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করার জন্য কিয়েভের ওপর চাপ বাড়বে। কারণ মার্কিন আইনপ্রণেতারা বিশাল সহায়তা প্যাকেজ পাস করতে ক্রমশ অনিচ্ছুক হয়ে উঠছে।
  

মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত ইস্যুতে

 

মার্কিন নির্বাচনে অন্যতম প্রধান আলোচিত ইস্যু মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় দলই এ নিয়ে কথা বলেছেন এবং এখনও বলে যাচ্ছেন। গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে সংঘটিত গণহত্যার ক্ষেত্রে উভয় দলের নেতারা একই অবস্থান নিয়েছেন এবং এ ঘটনার পক্ষে উভয় শিবিরই সমর্থন দিয়ে আসছে।
 
অর্থাৎ গাজায় ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসন ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। উভয়ে একই অবস্থান নিয়েছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সমর্থিত নেতা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য তারা সমানভাবে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
 
দুজন প্রার্থীই বোমাবর্ষণ, ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা, চিকিৎসার সুযোগ না দেয়া, রোগের বিস্তার ঘটানো, জোরপূর্বক স্থানান্তর ইত্যাদিসহ সেই সব ভয়ংকর নীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ফলে গাজায় ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এসব নিহত মানুষের একটা বড় অংশই নারী ও শিশু।
 
শুধু কৌশলগতভাবে নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় গাজা ও পশ্চিম তীরে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র দ্বারা সংঘটিত এসব অপরাধ বর্ণনা করতে ট্রাম্প ও হ্যারিস উভয়েই ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। 
 
 
উভয় রাজনৈতিক দল ইসরাইলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দিচ্ছে এবং যারা এ অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাদের সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, অর্থাৎ যে-ই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না কেন, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের তেমন কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
 
যদিও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা বলছেন, ‘নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধ করতে হবে’। তবে তিনি বারবার এ কথাও বলছেন যে, ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ রয়েছে। যা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেই শুরু থেকেই বলে আসছেন। 
 
অন্যদিকে ট্রাম্প একদিকে বলছেন যে, ‘শান্তি ফেরানোর এবং মানুষ হত্যা বন্ধ করার সময় এসেছে’। তবে তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এ কথাও বলে দিয়েছেন যে, ‘তোমার যা করা তা করো’। যার মানে, তিনি নেতানিয়াহুকে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন।
  

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ওপর প্রভাব

 

ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে আপাতদৃষ্টিতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক নেতাদের অবস্থান একে অপরের বিরোধী বলেই প্রতীয়মান হয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই কিয়েভের জেলেনস্কি সরকারকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক- সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে জো বাইডেন প্রশাসন। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার কোটি ডলার সরবরাহ করেছে তারা।
 
ডেমোক্রেটিক মনোনীত প্রার্থী হ্যারিস স্পষ্টভাবেই বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে পারলে নিজেকে গর্বিত মনে করবেন। তার কথায়, ‘আমি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াবো। এবং এই যুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয় নিশ্চিত করতে আমি কাজ করব।’ ফলে এটা ধরেই নেয়া যায়, কমলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, ইউক্রেন ইস্যুতে তার সরকারের বর্তমান অবস্থানই অব্যাহত থাকবে।
 
 
বিপরীতে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের বিষয়ে বলতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করতে কখনও পিছপা হননি ট্রাম্প। সেই সঙ্গে তিনি বারবার স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তিনি এই যুদ্ধের অবসান চান। তবে সামরিক ও আর্থিক সমর্থনের আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি এক নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, ‘আমি (ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে) বের হব। আমাদেরকে বের হতে হবে।
 
অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কঠোর সমালোচনা করেছেন রিপাবলিকান এ নেতা। গত অক্টোবরের মাঝামাঝি পিবিডি পডকাস্টে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘জেলেনস্কি হলেন আমার দেখা সবচেয়ে সেরা বিক্রয়কর্মী। যতবার তিনি আসেন, আমরা তাকে ১০ হাজার কোটি ডলার করে দিয়ে দিই। ইতিহাসে আর কে এভাবে অর্থ পেয়েছেন? কখনোই কেউ নন। আর এর মানে এই নয় যে আমি তাকে সহযোগিতা করতে চাই না। কারণ মানুষগুলোর জন্য আমার খারাপ লাগে। তাঁর কখনোই এ যুদ্ধ শুরু হতে দেয়া উচিত হয়নি।’
 
সূত্র: বিবিসি, আলজাজিরা