ঢাকা ০৯:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজ :
Logo ‘রাজনীতিবিদদের অবদানকে অস্বীকার করার অর্থ দেশের সংস্কারকে অস্বীকার করা’ Logo দিল্লিতে সংসদ ভবনের বাইরে গায়ে আগুন দিলো যুবক Logo বুয়েট শিক্ষার্থী নিহত: তিন আসামি রিমান্ড শেষে কারাগারে Logo সাগরে ডুবে গেল বাংলাদেশ থেকে ফেরা সেই রুশ জাহাজ Logo দুর্গমপাহাড়ে খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বড়দিন উদযাপন Logo টিনের কৌটা ভেবে পড়ে থাকা বোমায় লাথি, বিস্ফোরণে এলাকায় আতঙ্ক Logo চীনকে ঠেকাতেই কি পানামা খাল দখলে নিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প? Logo জাতীয় দলে ফেরা নিয়ে যা বললেন সাব্বির রহমান Logo খালেদা জিয়া লন্ডন যাচ্ছেন কবে, জানালেন চিকিৎসক Logo বাগেরহাটে স্বেচ্ছায় ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে দিলো জামায়াত

চীনকে ঠেকাতেই কি পানামা খাল দখলে নিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প?

নিজস্ব সংবাদ :

ছবি সংগৃহীত

চীনকে ঠেকাতেই কি পানামা খাল দখলে নিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প?

গত ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশ ও তার নেতাদের উদ্দেশ করে হুমকিধমকি দিতে শুরু করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি ঘনিষ্ঠ মিত্র ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে সেই অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার মতো উদ্ভট প্রস্তাব দিয়ে পুরো বিশ্বেই শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি ট্রাম্প। এবার মধ্য আমেরিকার স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র পানামার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নৌচলাচল রুট ‌‘পানামা খাল’ কেড়ে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি।


মূলত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং আলটপকা মন্তব্যের জন্য বিশ্বজুড়ে বেশ পরিচিতি রয়েছে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা জুড়েই নানান সময়ে বেসামাল মন্তব্যের জন্য আলোচিত ও সমালোচিত হয়ে আসছেন তিনি। তার ওপর গত ৪ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাওয়া সহজ জয় যেন আরও খানিকটা লাগামহীন করে দিয়েছে ট্রাম্পের মুখের বাঁধন। তবে পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের এই মন্তব্য নিছকই একটি বেসামাল উক্তি নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থও। বিশেষ করে পানামা খাল ঘিরে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে চাওয়াও এর অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।


মূলত সুয়েজ খাল কিংবা মালাক্কা প্রণালীর মতোই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলোর একটি পানামা খাল। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দুই মহাসাগর আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে এই খাল। এর মাধ্যমে কমেছে কয়েক হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। পানামা খালের মধ্য দিয়ে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের দূরত্ব মাত্র ৮২ কিলোমিটার। অপরদিকে পানামা খাল না থাকলে এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগর পাড়ি দিতে ঘুরতে হতো অতিরিক্ত আরও ১৩ হাজার কিলোমিটারের জলপথ। এই দূরত্ব কমানোর মাধ্যমে পানামা খাল পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যরুটে।

প্রতি বছর আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরগামী হাজার হাজার জাহাজ পাড়ি দেয় এই খাল। বহন হয় কোটি কোটি টন পণ্য। এক হিসেবে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে পানামা খাল পাড়ি দিয়েছে ১০ হাজার জাহাজ। বহন হয়েছে ৪২ কোটি টন পণ্য। উত্তরপূর্ব এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া পণ্যের ৪০ শতাংশই পরিবহন হয়েছে পানামা খাল দিয়ে। এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয়েছে পানামা খালের সবচেয়ে বড় একক ব্যবহারকারীতে। বছরে পানামা খাল দিয়ে বহন হওয়া পণ্যের তিন চতুর্থাংশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে পানামা খাল ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পেছনেই অবস্থান করছে চীন।

বর্তমানে পানামা খালের মালিকানা মধ্য আমেরিকার স্বাধীন রাষ্ট্র পানামার সরকারের হাতে থাকলেও এক সময় এই খালটি পরিচালনা করতো যুক্তরাষ্ট্র। বিগত শতাব্দীর একদম শুরুর দিকে ১৯০৩ সালে পানামাকে প্রতিবেশী কলম্বিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন হতে সাহায্য করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। বিনিময়ে পানামা খাল খননের অধিকার গ্রহণ করে ওয়াশিংটন। ১৯০৪ সালে শুরু হয় খাল খোঁড়ার কাজ। প্রায় এক দশকের নির্মাণযজ্ঞের পর আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯১৪ সালে শুরু হয় এই খালের কার্যক্রম। আর এর মাধ্যমে বিশ্বের জাহাজ চলাচল ও নৌবাণিজ্যের ইতিহাসে শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়ের।

তবে পানামা খালের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই খবরদারির বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছিলো পানামায়। এরই ধারাবাহিকতায় খালে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভে ফেটে পড়ে পানামাবাসী। রক্তক্ষয়ী এই বিক্ষোভে প্রাণ হারান প্রায় ২৮ জন মানুষ। পানামাবাসীর ক্ষোভের পাশাপাশি পানামা খাল পরিত্যাগ করতে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি। শেষ পর্যন্ত নিন্দার মুখে ১৯৭৭ সালে খালটি পানামার হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য দেশটির সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। এরপরও প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি সময়ে যৌথ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে চূড়ান্তভাবে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ দেশটির কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় ওয়াশিংটন।
 

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পানামা খালের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছরই পানামা খাল দিয়ে হাজার হাজার জাহাজ চলাচল করে, যার গন্তব্য থাকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল। তবে শুধু বাণিজ্যিক কারণেই নয়, সামরিক দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পানামা খাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই খালের মাধ্যমেই একইসঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। পানামা দিয়ে খুব সহজেই এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগর কিংবা নিজেদের এক উপকূল থেকে আরেক উপকূলে সব ধরনের যুদ্ধজাহাজ ও সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তর করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

পানামা খাল ব্যবহারের জন্য শুল্ক দিতে হয় প্রতিটি জাহাজকে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট পণ্যই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পরিবহন হয় এই খাল দিয়ে, সে হিসেবে এই খাল অতিক্রম করতে সবচেয়ে বেশি শুল্ক দিতে হয় মার্কিনিদেরই। আর এই বিষয়টিতেই নিজের বিরক্তি প্রকাশ করছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার মতে, পানামা খাল ব্যবহারে জাহাজের শুল্ক অতিরিক্ত। নিজের ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘পানামা যে শুল্ক আরোপ করে তা উদ্ভট।’ তিনি একে ঠকানো হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘তার দেশকে ঠকানোর এই বিষয়টিকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’
 
পানামা খাল ব্যবহারে জাহাজ ভাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য এজন্য বৈশ্বিক উষ্ণতাকেই দায়ী করছেন দেশটির কর্তৃপক্ষ। পানামা কর্তৃপক্ষের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে পানামা খাল সংলগ্ন জলাধারগুলো বর্তমানে পানিসংকটে ভুগছে। এর ফলে খালটি দিয়ে জাহাজ চলাচলের সক্ষমতা আগের চেয়ে কমেছে।

২০২৩ সালে ব্যাপক খরার কারণে প্রায় বন্ধই হতে বসেছিল পানামা খাল। খরার কারণে দৈনিক এই খাল ব্যবহার করে জাহাজ পারাপারের সংখ্যা নেমে এসেছিলো মাত্র ২২টিতে। সে সময় পানামা খালের দুই প্রান্তের সমুদ্রে তৈরি হয়েছিলো বিশাল জাহাজ জটের। খালটি পাড়ি দিতে অনেক ক্ষেত্রে এক সপ্তাহেরও বেশি সময়ে ধরে অপেক্ষা করতে হতো জাহাজগুলোকে। সে সময় বিষয়টি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে। অবশ্য পরিবর্তীতে এই খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল ফের স্বাভাবিক হলেও এই খাল ব্যবহারে জাহাজের শুল্ক ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন কিছুদিন আগে পানামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়া ডানপন্থি ও জাতীয়তাবাদী নেতা হোসে রাউল মুলিনো। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রই এই খালের প্রধান ব্যবহারকারী, তাই ভাড়া বৃদ্ধির মাশুল তাদেরই বহন করতে হবে সবচেয়ে বেশি। আর তাই মুলিনোর এই ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ততেই চটেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
 

ভাড়া বাড়ানোর মুলিনোর এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের এই হুমকির পেছনে রয়েছে চীনের ব্যাপারে তার উদ্বেগের বিষয়টিও। ট্রাম্পসহ যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল মহলের অনেকেরই ধারণা, ওয়াশিংটনকে চাপে রাখতে পানামার দিকে চোখ দিয়েছে বেইজিং। এর অংশ হিসেবে পানামার আশপাশে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে প্রভাব বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে তারা।

হংকংভিত্তিক একটি কোম্পানি পানামা খাল সংলগ্ন পাঁচটি বন্দরের মধ্যে দুটি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। এই বন্দর দুটি পানামা খালের দুই প্রান্তে অবস্থিত। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, ভবিষ্যতে পানামাকে কেন্দ্র করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে চীন। যা হুমকিতে ফেলবে পানামাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থকে।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্বেগ সম্পর্কে সতর্ক রয়েছে পানামাও। যার প্রমাণ রোববার ট্রাম্পের বক্তব্যের পর দেয়া প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করে পানামার প্রেসিডেন্ট মুলিনো বলেন, পানামা খাল এবং সংলগ্ন অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি পানামার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা একইভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। একই সঙ্গে পানামা খালে চীন কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকেও তিনি অস্বীকার করেন। পাশাপাশি পানামা খালের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তও আকস্মিকভাবে নেয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।

পানামার অস্তিত্ব ও অর্থনীতির জন্য এই খাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির রাজস্বের ২০ ভাগই আসে এই খাল থেকে। এ অবস্থায় ট্রাম্পের পানামা খাল কেড়ে নেয়ার মন্তব্যে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন পানামাবাসী।
 

 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ১০:৩৩:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
১ বার পড়া হয়েছে

চীনকে ঠেকাতেই কি পানামা খাল দখলে নিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প?

আপডেট সময় ১০:৩৩:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

চীনকে ঠেকাতেই কি পানামা খাল দখলে নিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প?

গত ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশ ও তার নেতাদের উদ্দেশ করে হুমকিধমকি দিতে শুরু করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি ঘনিষ্ঠ মিত্র ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে সেই অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার মতো উদ্ভট প্রস্তাব দিয়ে পুরো বিশ্বেই শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি ট্রাম্প। এবার মধ্য আমেরিকার স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র পানামার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নৌচলাচল রুট ‌‘পানামা খাল’ কেড়ে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি।


মূলত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং আলটপকা মন্তব্যের জন্য বিশ্বজুড়ে বেশ পরিচিতি রয়েছে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা জুড়েই নানান সময়ে বেসামাল মন্তব্যের জন্য আলোচিত ও সমালোচিত হয়ে আসছেন তিনি। তার ওপর গত ৪ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাওয়া সহজ জয় যেন আরও খানিকটা লাগামহীন করে দিয়েছে ট্রাম্পের মুখের বাঁধন। তবে পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের এই মন্তব্য নিছকই একটি বেসামাল উক্তি নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থও। বিশেষ করে পানামা খাল ঘিরে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে চাওয়াও এর অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।


মূলত সুয়েজ খাল কিংবা মালাক্কা প্রণালীর মতোই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলোর একটি পানামা খাল। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দুই মহাসাগর আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে এই খাল। এর মাধ্যমে কমেছে কয়েক হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। পানামা খালের মধ্য দিয়ে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের দূরত্ব মাত্র ৮২ কিলোমিটার। অপরদিকে পানামা খাল না থাকলে এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগর পাড়ি দিতে ঘুরতে হতো অতিরিক্ত আরও ১৩ হাজার কিলোমিটারের জলপথ। এই দূরত্ব কমানোর মাধ্যমে পানামা খাল পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যরুটে।

প্রতি বছর আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরগামী হাজার হাজার জাহাজ পাড়ি দেয় এই খাল। বহন হয় কোটি কোটি টন পণ্য। এক হিসেবে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে পানামা খাল পাড়ি দিয়েছে ১০ হাজার জাহাজ। বহন হয়েছে ৪২ কোটি টন পণ্য। উত্তরপূর্ব এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া পণ্যের ৪০ শতাংশই পরিবহন হয়েছে পানামা খাল দিয়ে। এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয়েছে পানামা খালের সবচেয়ে বড় একক ব্যবহারকারীতে। বছরে পানামা খাল দিয়ে বহন হওয়া পণ্যের তিন চতুর্থাংশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে পানামা খাল ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পেছনেই অবস্থান করছে চীন।

বর্তমানে পানামা খালের মালিকানা মধ্য আমেরিকার স্বাধীন রাষ্ট্র পানামার সরকারের হাতে থাকলেও এক সময় এই খালটি পরিচালনা করতো যুক্তরাষ্ট্র। বিগত শতাব্দীর একদম শুরুর দিকে ১৯০৩ সালে পানামাকে প্রতিবেশী কলম্বিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন হতে সাহায্য করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। বিনিময়ে পানামা খাল খননের অধিকার গ্রহণ করে ওয়াশিংটন। ১৯০৪ সালে শুরু হয় খাল খোঁড়ার কাজ। প্রায় এক দশকের নির্মাণযজ্ঞের পর আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯১৪ সালে শুরু হয় এই খালের কার্যক্রম। আর এর মাধ্যমে বিশ্বের জাহাজ চলাচল ও নৌবাণিজ্যের ইতিহাসে শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়ের।

তবে পানামা খালের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই খবরদারির বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছিলো পানামায়। এরই ধারাবাহিকতায় খালে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভে ফেটে পড়ে পানামাবাসী। রক্তক্ষয়ী এই বিক্ষোভে প্রাণ হারান প্রায় ২৮ জন মানুষ। পানামাবাসীর ক্ষোভের পাশাপাশি পানামা খাল পরিত্যাগ করতে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি। শেষ পর্যন্ত নিন্দার মুখে ১৯৭৭ সালে খালটি পানামার হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য দেশটির সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। এরপরও প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি সময়ে যৌথ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে চূড়ান্তভাবে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ দেশটির কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় ওয়াশিংটন।
 

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পানামা খালের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছরই পানামা খাল দিয়ে হাজার হাজার জাহাজ চলাচল করে, যার গন্তব্য থাকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল। তবে শুধু বাণিজ্যিক কারণেই নয়, সামরিক দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পানামা খাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই খালের মাধ্যমেই একইসঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। পানামা দিয়ে খুব সহজেই এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগর কিংবা নিজেদের এক উপকূল থেকে আরেক উপকূলে সব ধরনের যুদ্ধজাহাজ ও সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তর করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

পানামা খাল ব্যবহারের জন্য শুল্ক দিতে হয় প্রতিটি জাহাজকে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট পণ্যই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পরিবহন হয় এই খাল দিয়ে, সে হিসেবে এই খাল অতিক্রম করতে সবচেয়ে বেশি শুল্ক দিতে হয় মার্কিনিদেরই। আর এই বিষয়টিতেই নিজের বিরক্তি প্রকাশ করছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার মতে, পানামা খাল ব্যবহারে জাহাজের শুল্ক অতিরিক্ত। নিজের ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘পানামা যে শুল্ক আরোপ করে তা উদ্ভট।’ তিনি একে ঠকানো হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘তার দেশকে ঠকানোর এই বিষয়টিকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’
 
পানামা খাল ব্যবহারে জাহাজ ভাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য এজন্য বৈশ্বিক উষ্ণতাকেই দায়ী করছেন দেশটির কর্তৃপক্ষ। পানামা কর্তৃপক্ষের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে পানামা খাল সংলগ্ন জলাধারগুলো বর্তমানে পানিসংকটে ভুগছে। এর ফলে খালটি দিয়ে জাহাজ চলাচলের সক্ষমতা আগের চেয়ে কমেছে।

২০২৩ সালে ব্যাপক খরার কারণে প্রায় বন্ধই হতে বসেছিল পানামা খাল। খরার কারণে দৈনিক এই খাল ব্যবহার করে জাহাজ পারাপারের সংখ্যা নেমে এসেছিলো মাত্র ২২টিতে। সে সময় পানামা খালের দুই প্রান্তের সমুদ্রে তৈরি হয়েছিলো বিশাল জাহাজ জটের। খালটি পাড়ি দিতে অনেক ক্ষেত্রে এক সপ্তাহেরও বেশি সময়ে ধরে অপেক্ষা করতে হতো জাহাজগুলোকে। সে সময় বিষয়টি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে। অবশ্য পরিবর্তীতে এই খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল ফের স্বাভাবিক হলেও এই খাল ব্যবহারে জাহাজের শুল্ক ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন কিছুদিন আগে পানামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়া ডানপন্থি ও জাতীয়তাবাদী নেতা হোসে রাউল মুলিনো। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রই এই খালের প্রধান ব্যবহারকারী, তাই ভাড়া বৃদ্ধির মাশুল তাদেরই বহন করতে হবে সবচেয়ে বেশি। আর তাই মুলিনোর এই ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ততেই চটেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
 

ভাড়া বাড়ানোর মুলিনোর এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের এই হুমকির পেছনে রয়েছে চীনের ব্যাপারে তার উদ্বেগের বিষয়টিও। ট্রাম্পসহ যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল মহলের অনেকেরই ধারণা, ওয়াশিংটনকে চাপে রাখতে পানামার দিকে চোখ দিয়েছে বেইজিং। এর অংশ হিসেবে পানামার আশপাশে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে প্রভাব বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে তারা।

হংকংভিত্তিক একটি কোম্পানি পানামা খাল সংলগ্ন পাঁচটি বন্দরের মধ্যে দুটি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। এই বন্দর দুটি পানামা খালের দুই প্রান্তে অবস্থিত। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, ভবিষ্যতে পানামাকে কেন্দ্র করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে চীন। যা হুমকিতে ফেলবে পানামাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থকে।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্বেগ সম্পর্কে সতর্ক রয়েছে পানামাও। যার প্রমাণ রোববার ট্রাম্পের বক্তব্যের পর দেয়া প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করে পানামার প্রেসিডেন্ট মুলিনো বলেন, পানামা খাল এবং সংলগ্ন অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি পানামার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা একইভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। একই সঙ্গে পানামা খালে চীন কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকেও তিনি অস্বীকার করেন। পাশাপাশি পানামা খালের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তও আকস্মিকভাবে নেয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।

পানামার অস্তিত্ব ও অর্থনীতির জন্য এই খাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির রাজস্বের ২০ ভাগই আসে এই খাল থেকে। এ অবস্থায় ট্রাম্পের পানামা খাল কেড়ে নেয়ার মন্তব্যে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন পানামাবাসী।